বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রয়াত ফাদার টিম এর স্মরণে নাগরিক স্মরণানুষ্ঠান

প্রয়াত ফাদার টিম এর স্মরণে নাগরিক স্মরণানুষ্ঠান

গত ২৩ অক্টোবর, প্রয়াত ফাদার টিম এর স্মরণে রাজধানীর শান্তিবাগে কারিতাস বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক স্মরণানুষ্ঠান।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনঃগঠন এবং বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে ফাদার টিমকে এদেশের মানুষ চিরদিন স্মরণে রাখবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেও ভোগ-বিলাসিতা ত্যাগ করে বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে ও আর্ত মানবতার সেবায় ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন মানবতাবাদী এই ব্যক্তিত্ব।

গত ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সাউথ বেন্ডের হলি ক্রস হাউজে ৯৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

ফাদার টিম ঢাকার নটরডেম কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদাতাদের মধ্যে ছিলেন একজন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশের খ্যাতনামা এই কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সূচনা হয়েছিল।

কারিতাস বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা ডঃ রেভাঃ ফাঃ হিউবার্ট লিটন গমেজ এর প্রার্থনা এবং নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন ফ্রান্সিস রোজারিও-এর স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া এ স্মরণ সভায় স্মৃতিকথা ও অনুভূতি প্রকাশ করেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসিসহ অন্যান্য অতিথিবর্গ।

কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, “ফাদার টিম বেঁচে আছেন। তিনি অমর তাঁর চিন্তায়, তাঁর কথায়, তাঁর কাজে।” 

মাননীয় সংসদ সদস্য ও নির্বাহী পরিচালক, প্রিপ ট্রাস্ট মিজ্ আরমা দত্ত বলেন, “ফাদার টিম ছিলেন আমাদের উন্নয়নধারার প্রবর্তক। উনি ছিলেন বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্রষ্টা।”

এডাব সভাপতি জয়ন্ত অধিকারী, প্রধান সমন্বয়কারী নিজেরা করি, মিজ্্ খুশি কবীর, আইপিডিএস সভাপতি সঞ্জিব দ্রং, ডঃ বেনেডিক্ট আলো ডি’ রোজারিও, নটর ডেম কলেজের উপাচার্য ডঃ রেভাঃ ফাঃ প্যাট্রিক গাফনি, সিএসসি স্মৃতিচারণ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফাদার টিম-এর বর্ণ্যাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন।

এ মহতি অনুষ্ঠানের সমাপনী লগ্নে কারিতাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিশপ জের্ভাস রোজারিও উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে গিয়ে বলেন, “ফাদার টিম বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি রচনা করেছেন। নিঃস্বার্থভাবে তিনি সেবা করেছেন গ্রামে-গঞ্জে জনপদে।”

উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূণিঝড় এবং ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের অতুলনীয় ক্ষতি সাধিত হয় এই সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য তিনি নিজেকে পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলেন।

১৯৭১ থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ছয় মাসের জন্য ফাদার টিম মনপুরা দ্বীপে ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রকল্পের পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে International Understanding ও বাংলাদেশের উন্নয়নে দীর্ঘ ৩৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য ফাদার টিম ম্যাগসায়সায় পুরস্কারে ভূষিত হন। একই বছর সমাজ সেবায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করায় তিনি আবু সাইয়ীদ চৌধুরী পুরস্কারে ভূষিত হন।

তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর পর তিনবার এর সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি South Asian Forum for Human Rights প্রতিষ্ঠা করেন ও আহ্বায়কের কাজ করেন।

২০০০ থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ফাদার টিম বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। তাঁর এ সময়কার বিশেষ বিশেষ কাজগুলো ছিল: আদিবাসীদের অধিকার ও উন্নয়ন, দরিদ্র ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিলাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি।

২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কারিতাস বাংলাদেশের পরামর্শক নিয়োজিত হন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ভাটিকান পন্টিফিকাল কাউন্সিল ফর জাস্টিস এ্যান্ড পিস বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট লেখক, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, এবং মানবাধিকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার জন্য বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে  বাংলাদেশ সরকার তাকে “মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মননা” প্রদান করেন।

তিনি নটর ডেম কলেজের ষষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার হাতে ধরেই কলেজটিতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয় এবং ১৯৫৫ সালে তিনি নটর ডেম কলেজ সায়েন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।

এছাড়া কলেজটির ডিবেটিং ক্লাব ও নটর ডেম কলেজ অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, প্রাণিবিদ এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সক্রিয় কর্মী, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরিতে কাজ করা বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।

ফাদার টিমের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় ১৯২৩ সালের ২ মার্চ। তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৫২ সালে।

ফাদার টিম ছয় দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে থেকে এদেশের শিক্ষার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ফাদার টিম বেঁচে আছেন। তিনি অমর তাঁর চিন্তায়, তাঁর কথায়, তাঁর কাজে। 

 

Add new comment

2 + 0 =