বিশ্ব প্রেরণ রবিবার ২০২০ উপলক্ষ্যে পূণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিসের বাণী: “এই তো আমি, আমাকে পাঠান” (ইসা ৬:৮)

গত অক্টোবরের বিশেষ মিশনারী মাস উদযাপন উপলক্ষ্যে সারা পৃথিবীতে খ্রীষ্ট মণ্ডলী যা কিছু আয়োজন করেছে, তার সব দায়ভার গ্রহণ করে আমি পিতা ঈশ^রকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি, দীক্ষিত ও প্রেরিত: বিশ^ব্যাপী মণ্ডলীর প্রেরণকর্ম”- এই মূলসুর অনেক দেশের মানুষের মাঝে প্রেরণ কার্যের মধ্যে নবচেতনা ও গতিশীলতা সঞ্চার করেছে।

কোবিট-১৯ মহামারী সৃষ্ট দুর্দশা ও পরীক্ষা দ্বারা চিহ্নিত এই বছরে বিশ^ খ্রীষ্টমণ্ডলী তার মিশনারী যাত্রা অব্যাহত রাখবে পবিত্র শাস্ত্র বাণী আলোয় আলোকিত হয়ে, যার বর্ণনা আমরা পাই প্রবক্তা ইসাইয়ার আহ্বানের মধ্যে: “এই তো আমি, আমাকে পাঠান” (ইসাইয়া: ৬:৮)। এটা হচ্ছে সদা প্রভুর প্রশ্নের চির নতুন উত্তর: “আমি কাকে পাঠাব?”(ঐ)। বর্তমান পৃথিবীর এ মহা সংকটের সময় করুনাসিক্ত ঐশ হৃদয়ের এই আহ্বান বাণী মণ্ডলী এবং মানব জাতি উভয়কেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। মঙ্গলসমাচারে বর্ণিত অপ্রত্যাশিত প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়া শিষ্যদের মতোই আমাদের সবার অবস্থা। আমরা উপলদ্ধি করি যে, আমরা সেই একই নৌকার যাত্রী; সবাই আমরা ভঙ্গুর ও ভয়ে দিশেহারা। তবে একই সঙ্গে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, আমাদের একসঙ্গে দাঁড় বাইতে হবে, বিপদের সময় একে অপরকে সাহায্য  করতে হবে। জীবন নৌকার মধ্যে এই একতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। শিষ্যদের মতোই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আমরাও এক সঙ্গে বলে উঠি: “আমরা যে মরতে বসেছি” (দ্র: মার্ক ৪:৩৮)। এর অর্থ হচ্ছে আমরা উপলদ্ধি করি যে, শুধু মাত্র নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারিনা। আমরা অবশ্যই ভীত-সন্ত্রস্ত এবং দিশেহারা। দুঃখ-যন্ত্রণা ও মৃত্যু আমাদেরকে মানবীয় ভঙ্গুরতা অভিজ্ঞতা করতে সহায়তা করে। আবার একই সঙ্গে এটা জীবনের প্রতি আমাদের গভীর মমতা এবং মন্দতা হতে নিষ্কৃতি লাভের কথাও  স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কারণেই প্রেরণ কাজ, যা ঈশ^র ও প্রতিবেশীকে ভালবাসার একটা আমন্ত্রণ, তা আমাদেরকে সহভাগিতা, সেবা কাজ ও প্রার্থনা করার একটা সুযোগ এনে দেয়। আমাদের প্রত্যেক জনকে ঈশ^র প্রেরণ দায়িত্ব দিয়েছেন যেন সকল ভয় ও অর্ন্তদর্শন থেকে মুক্ত করে তা আমাদেরকে এক নবায়িত উপলদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর এর মধ্য দিয়ে পরের তরে সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে আমরা নিজেকে পুরোপুরি ভাবে খুঁজে পাই।

যীশুর প্রেরণকর্মের পূর্ণতা - সেই ক্রুশীয় বলিদানের মাধ্যমে ( দ্র; যোহন ১৯:২৮) ঈশ^র আমাদের প্রত্যেকের জন্য তাঁর সুমহান ভালবাসা প্রকাশ করেন (দ্র: যোহন ১৯:২৬-২৭)। তিনি আমাদের প্রত্যেক জনকে ব্যক্তিগতভাবে প্রেরণ করতে ইচ্ছা পোষণ করেন। কারণ তিনি ¯¦য়ং ভালবাসা, যে ভালবাসা সব সময় প্রেরণকার্যে নিয়োজিত, যে ভালবাসা সর্বদা জীবন দানের জন্য আপন গন্ডির বাইরে প্রসারিত। আমাদের  প্রতি তাঁর  ভালবাসার চুড়ান্ত প্রমাণ স্বরূপ ঈশ^র তাঁর একমাত্র পুত্রকে এ জগতে প্রেরণ করলেন (দ্র: যোহন ৩:১৬)। পিতা কর্তৃক প্রেরিত যীশু তাঁর সমগ্র জীবন ও সেবাকর্মে ঐশ ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ বাধ্যতা প্রকাশ করেছেন (দ্র: যোহন ৪: ৩৪, ৬: ৩৮; হিব্রু ১০:৫-১০)। ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থিত যীশু সবর্দা আমাদের তাঁর কাছে টানেন তাঁরই ভালবাসার প্রেরণকর্মী হওয়ার জন্য। তাঁর পরম আত্মা, যিনি মণ্ডলীর প্রাণ-সঞ্চালক, তিনিই আমাদেরকে তাঁর শিষ্য করে তোলেন এবং এই জগত ও জগতের মানুষের কাছে পাঠান তাঁর প্রেরণ কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য।

প্রেরণ কর্ম, চলমান মণ্ডলী- একটা সাধারণ কর্মসূচি নয় । এটা একটা দুঃসাহসিক কমর্ প্রচেষ্টা, যা বিশুদ্ধ ইচ্ছা শক্তি দ্বারা চালিত হতে হয়। যীশু খ্রীষ্ট মণ্ডলীকে তাঁর গন্ডির বাইরে যেতে বাধ্য করেন। বাণী প্রচারের প্রেরণ কর্মে তুমি বেরিয়ে পড় কারণ পবিত্র আত্মা তোমাকে তা করতে তাগিদ দেন এবং পরিচালিত করেন” ( জান্নি ভালেন্তের সঙ্গে কথোপকথন, ভাতিকান লাইব্রেরী, সান পাওলো, ২০১৯, ১৭-১৮)। ঈশ^রই সর্ব প্রথম আমাদের ভালবেসেছেন এবং তাঁর এই ভালবাসা দিয়েই তিনি আমাদের কাছে আসেন, আমাদেরকে  ডাকেন। মণ্ডলীতে আমরা  ঈশ^রের পুত্র-কন্যা, তাঁর পরিবারে যীশুর দেখানো ভালবাসায় আমরা একে-অন্যের ভাই-বোন। আর এই বাস্তবতা থেকেই আমাদের ব্যক্তিগত আহ্বান আসে একেক জন প্রেরণকর্মী হওয়ার জন্য। অতএব, ঐশ সন্তান হওয়ার আহ্বানের মধ্যেই সকল মানুষের মানবিক মর্যাদা  বিদ্যমান। দীক্ষাস্নান সংস্কার ও বিশ^াসের স্বাধীনতায় তারা ঐশ সন্তান হয়ে উঠে, যে ভাবে সবর্দাই তারা ঈশ^রের হৃদয় গভীরে ছিল।

মানব জীবন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রাপ্ত একটা ঐশদান। এই জীবন সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হওয়ার জন্য আহ্বান পায়। এই জীবন হল একটা বীজ, যা দীক্ষাস্নানে অঙ্কুরিত হবে; বিবাহ সংস্কারে বা ঐশ রাজ্যের জন্য কৌমার্য ব্রত গ্রহনে ভালবাসার প্রতিদান হিসাবে প্রকাশিত হবে। মানব জীবন ঐশ ভালবাসার মধ্যে বেড়ে উঠে এবং ভালবাসার দিকেই ধাবিত হয়। ঐশ ভালবাসার বাইরে আমরা কেই নয়। তাঁর পুত্র যীশুর ক্রুশীয় আত্ম বলিদানের মাধ্যমে ঈশ^র পাপ ও মৃত্যু  শক্তিকে  জয় করেছেন (দ্র: রোমীয় ৮:৩১-৩৯)। ঈশ^রের কাছে মন্দতা এমনকি পাপও হয়ে উঠেছে বৃহত্তর ভালবাসায় সাড়া দেওয়ার একটা বড় বাধা হিসেবে। মুক্তি রহস্যে ঐশ অনুগ্রহ মানব জাতির ক্ষত নিরাময় করেছে এবং সারা বিশে^ তা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। খ্রীষ্ট মণ্ডলী, যা জগতের জন্য ঐশ ভালবাসার সার্বজনীন সাক্রামেন্ত, এই মন্ডলী মানব ইতিহাসে যীশুর প্রেরণ কাজ চলমান রাখে এবং আমাদেরকে সর্বত্র প্রেরণ করে যেন আমাদের বিশ^াসের সাক্ষ্যদান ও মঙ্গলবাণী ঘোষণার মাধ্যমে ঈশ^র তাঁর ভালবাসার প্রকাশ অব্যাহত রাখেন। ঈশ^র যেন এভাবেই প্রত্যেক স্থান ও সময়ে মানুষের দেহ, মন, আত্মা, সমাজ ও সংস্কৃতিকে  স্পর্শ করেন এবং রূপান্তরিত করেন।

প্রেরণ কাজ হচ্ছে ঐশ আহ্বানে স্বাধীন ও সচেতনভাবে সাড়া দেওয়া। তবুও আমরা এই আহ্বান যাচাই করি মণ্ডলীর মধ্যে বিদ্যমান যীশুর ভালবাসার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাপকাঠি দিয়ে। আসুন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি : বিবাহিত দম্পত্তি হই বা উৎসর্গীকৃত ব্যক্তিই হই কিংবা অভিষিক্ত সেবাকর্মীই হই না কেন, আমরা কি আমাদের জীবনে, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পবিত্র আত্মার উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত? প্রেরণ কাজে তাঁর ডাক শুনতে আমরা কি রাজি আছি? অসীম দয়ালু পিতার প্রতি আমাদের বিশ^াসের সাক্ষ্য দান করতে যেকোন জায়গায় যে কোন সময় প্রেরিত হতে আমরা কি ইচ্ছুক?  যীশু খ্রীষ্টের পরিত্রাণের মঙ্গলবাণী ঘোষণা করতে খ্রীষ্ট মণ্ডলী গঠন করে পবিত্র আত্মার ঐশ জীবন সহভাগিতা করতে আমরা কি ইচ্ছুক?  যীশুর মা মারীয়ার মতো ঈশ^রের ইচ্ছার হাতে নিজেকে সর্ম্পূণরূপে উৎসর্গ করতে আমরা কি প্রস্তুত? (দ্র: লুক ১:৩৮)। “এই তো আমি, প্রভু আমাকে পাঠান” (দ্র: ইসাইয়া ৬:৮)- ঈশ^রকে এই কথা বলার জন্য আমাদের হৃদয় গভীরে এই উন্মুক্ততা দরকার।

বিশ^ব্যাপী  মহামারীর এই দুঃসময়ে ঈশ^র আমাদের কি বলতে চান, তা উপলদ্ধি করা মণ্ডলীর প্রেরণ কাজের চ্যালেঞ্জ সমূহের মধ্যে অন্যতম। অসুস্থতা, দুঃখ-যন্ত্রণা, ভয় এবং নিঃসঙ্গতা আমাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যারা একাকী মারা যায়, যারা পরিত্যক্ত, যারা তাদের কাজ ও আয় হারিয়েছে, যারা গৃহহীন, যাদের খাবার নেই- এই সমস্ত লোকদের দু:খ দুর্দশা প্রতিনিয়ত আমাদের চ্যালেঞ্জ জানায়। সামাজিক দুরত্ব পালন এবং ঘরে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় আমরা পুনরায় আবিষ্কার করি যে, সামাজিক সম্পর্ক এবং ঈশ^রের সাথে আমাদের  সমবেত সর্ম্পকের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রমাগত অবিশ^াস ও উদাসীনতা থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্যদের সাথে সুসর্ম্পক গঠন করতে এই অবস্থা আমাদের আরো সচেতন করে তোলে। অন্য ভাই-বোনদের প্রয়োজন, তাদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা - ইত্যাদির প্রতি আমাদের হৃদয়কে উন্মত্ত করে তোলে সেই প্রার্থনা, যে প্রার্থনা দিয়ে ঈশ^র আমাদের হৃদয় মনকে স্পর্শ করেন। সকল সৃষ্টিকে যত্ন করতে সেই প্রার্থনাই আমাদের দায়িত্বশীল করে তোলে।

বিশ^ প্রেরণ রবিবার উদযাপন হলো আমাদের বিশ^াস নবায়নের এমন একটি উপলক্ষ্য, যেখানে প্রার্থনা, অনুধ্যান এবং বৈষয়িক অনুদানের মাধ্যমে মণ্ডলীতে যীশু খ্রীষ্টের প্রেরণ কাজে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করার সুযোগ আমরা লাভ করি। অক্টোবর মাসের ৩য় রবিবার পবিত্র উপাসনায় সংগৃহীত স্বেচ্ছাদানে ভালোবাসার যে বহিঃপ্রকাশ, তা  বিশ^াস বিস্তার সংস্থার মাধ্যমে আমার নামে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ কাজের সহায়তা রূপে ব্যয় করা হয়। সার্বজনীন পরিত্রাণার্থে, সারা জগতের মানুষ ও মণ্ডলীর আধ্যাত্মিক ও জাগতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই তা ব্যয় করা হয়।

মঙ্গলবাণী ঘোষণার তারকা, দুঃখীদের সান্ত¦নাদায়িনী এবং পুত্র যীশুর সহ-প্রেরণকর্মী ধন্যা কুমারী মারীয়া আমাদের জন্য অনুনয় প্রার্থনা অব্যাহত রাখুন এবং আমাদেরকে শক্তিদান করুন।-পোপ ফ্রান্সিস                                        

রোম, লাতেরান মহামন্দির; ৩১শে মে, ২০২০,  পবিত্র আত্মার অবতরণ মহাপর্ব, বাংলা অনুবাদ, ফা: রোদন রবার্ট হাদিমা

Add new comment

9 + 5 =