বাংলাভাষায় খ্রিষ্টীয় উপাসনারীতির প্রবর্তক ও অনুবাদক ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস.জে’র চিরবিদায়

বাংলাভাষায় খ্রিষ্টীয় উপাসনারীতির প্রবর্তক ও সার্থক অনুবাদক ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে. (মূল ফরাসি উচ্চারণ: জ্যঁ অঙ্লবের্) গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ, সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে সাধু ক্লদ দ্য লা কলোম্বিয়ের নামক যিশুসংঘের এক আরোগ্যনিবাসে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার মধ্যে তিনি ৭২ বছর যিশুসংঘে এবং ৬১ বছর কলকাতায় অতিবাহিত করেন।   

ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে. ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে নভেম্বর  মাসের ৭ তারিখে বেলজিয়ামে, ব্রাসেলস শহরের কাছেই জন্মগ্রহণ করেন । তিনি সেখানে জেজুইটদের স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা শেষ করে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে আরলোঁ শহরে যিশুসংঘের নব্যালয়ে যোগদান করেন।

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে চিরব্রত গ্রহণ করে তিনি এগেনহোভেন নামক স্থানে সেন্ট জন বার্কম্যান্স কলেজে দর্শনশাস্ত্র ও প্রাচ্যবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। ১৯ মার্চ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দার্জিলিং ভারতে জেলার কার্সিয়াং সেন্ট মেরিস ঐশতত্ত্ব অধ্যয়নকেন্দ্রে যাজকপদে অভিষিক্ত হন। 

যাজকীয় অভিষেকের পর বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে ঐকান্তিক অনুরাগের জন্য ফাদার এঙ্গেলবার্টকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনার সুযোগ দেওয়া হয়। যথাযথভাবে বাংলা ভাষা রপ্ত করে তিনি খ্রিষ্টিয় উপাসনার রীতি ও গীতি অনুবাদে মনোনিবেশ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর এই কাজে নিরলসভাবে নিবেদিত ছিলেন। 

বাংলাভাষায় খ্রিষ্টিয় উপাসনার বস্তুনিষ্ঠ ও যথাযথ অনুবাদে ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে.-র তুলনা মেলা ভার। তিনি দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভার নির্দেশনা অনুসারে উপাসনার সংস্কৃত্যায়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

ফরাসিভাষী বেলজিও মানুষ হওয়া সত্বেও উপাসনায় দেশীয় রীতির প্রবর্তনে তিনি পথিকৃৎ। বঙ্গদেশের খ্রিষ্টীয় উপাসনা তাঁর কাছে বাঙালি রীতিনীতিকেই শিরোধার্য করেছে। এমনকি ইউরোপের খ্রিষ্টীয় সাধু-সাধ্বীদের নামগুলোর যথাযথ বাংলা নামকরণে তিনি এক নতুন দিগন্ত অবারিত করে দিয়েছেন।          

কলকাতা প্রভু যিশু গির্জার অধীনে খ্রিষ্টপূজন প্রকাশনী থেকে ইংরেজি, ইতালিও  ও ফরাসি খ্রিষ্টাচার্যদের রচনাসমূহের সাবলীল বঙ্গানুবাদে ফা. জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে. ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যগীতেও সম্যক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। উল্লেখ্য খ্রিষ্টীয় উপাসনায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগে তিনি আরেক দিকপাল বঙ্গভাষা পন্ডিত স্বদেশী ফাদার রবার্ট আন্তোয়ান এস. জে.-র সঙ্গে একাত্ম হয়ে নতুন যুগলক্ষণের সূচনা করেন। 

ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে.-র অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে:   

১) 'গীতসঞ্চয়' খ্রিষ্টীয় উপাসনা সংগীত (১৯৬৬), অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। 

২) 'খ্রীষ্টযাগের প্রার্থনাবিতান' (১৯৭৭), দৈনিক খ্রিষ্টযাগের জন্য নির্দিষ্ট প্রার্থনা ও গীতিসমূহ 

৩) 'বাণীবিতান', আলাদা তিন খন্ড (রবিবাসরীয়, দৈনিক, ও বিবিধ), ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত।  

৪) 'খ্রীষ্টযজ্ঞের প্রার্থনা-সঙ্কলন' তিন খন্ড (রবিবাসরীয়, দৈনিক, ও বিবিধ), ১৯৯৫। 

৫) 'খ্রীষ্টযজ্ঞ'

৬) আশীর্বাদ গ্রন্থ, প্রথম খন্ড (১৯৯১) মূলত ব্যক্তি মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ উদ্দিষ্ট আশীর্বাদ সঙ্কলন। 

৭) আশীর্বাদ গ্রন্থ, দ্বিতীয় খন্ড (১৯৯১) মূলত মানুষের ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্যবহার্য আশীর্বাদ  সঙ্কলন। 

৮) আশীর্বাদ গ্রন্থ, তৃতীয় খন্ড (১৯৯১) মূলত মন্ডলীকে পূজনে ও ভক্তি প্রদর্শনে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জন্য ব্যবহার্য আশীর্বাদ  সঙ্কলন। 

৯) দৈনিক পাঠ-পরম্পরা, মোট ৫ খন্ডে প্রকাশিত (২০০৫)।

১০) 'সংস্কার পদ্ধতি' (১৯৯৮), খ্রিষ্টীয় সংস্কার প্রদানের নিয়মাবলি। 

  অসংখ্য গ্রন্থের সম্পাদনা ও প্রকাশনার পরও ফা. জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে., খ্রিষ্টভক্তদের পালকীয় ও গঠনদানের কাজে একনিষ্ঠ ছিলেন। কলকাতা প্রভু যিশু গির্জার পালক-পুরোহিত হিসাবে তিনি দীর্ঘদিন ভক্তদের, বিশেষত বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গিয়ে বসতিস্থাপনকারী খ্রীষ্টভক্তদের অন্তরের কাছের মানুষ হিসাবে পরিগণিত। 

খ্রিষ্টীয় জীবনসংঘ নামক আন্দোলনের প্রবর্তক ফা. জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে. বাংলাভাষা ও বাংলার মানুষের মধ্যে যে চেতনা-প্রেরণা পেয়েছেন এবং শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দিয়েছেন; আজ স্বর্গে থেকে আমাদের সেই ধারায় শুচিস্নাত করুন। অনন্ত শান্তি লাভ করুন ফাদার জন এঙ্গেলবার্ট এস. জে.।- ফাদার প্রদীপ পেরেজ এস.জে.

 

 

Add new comment

4 + 0 =