চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের প্রথম বাঙ্গালী বিশপ যোয়াকিম রোজারিও, সিএসসি-র মৃত্যুর ২৪ বছর

গত ৯ জুন ২০২০ খ্রিস্টাব্দে, চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের (বর্তমানে মহাধর্মপ্রদেশ) প্রথম বাঙ্গালী বিশপ যোয়াকিম রোজারিও, সিএসসি-র মৃত্যুর ২৪ বছর পার হয়ে গেল। তাঁকে বলা হ’ত- স্থানীয় খ্রীষ্টমন্ডলীর রূপকার, দেশীয় রীতি-কৃষ্টিতে উপাসনা (সংস্কৃতায়ন), আন্তঃধর্মীয় (অন্য মন্ডলী এবং অখ্রীষ্টান) সংলাপ, মান্ডলিক কাজে খ্রীষ্টভক্তদের আরো বেশী অংশগ্রহণ, মিশ্র বিবাহ, দ্বিতীয় ভ্যাটিকান মহাসভার দলিল বাস্তবায়নের উদ্যোক্তা, দরিদ্রদের বন্ধু। 

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের কারণে বিধ্বস্ত উপকূল অঞ্চলের মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য CORD (Chittagong Organization for Relief and Development)-এর  প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্মান করেন সাইক্লোন সেন্টার। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে CORD-এর কার্যক্রমকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত করে গঠিত হয় CORR (Christian Organization for Relief and Rehabilitation), CORR ও CORR CARITAS -এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে খ্রীষ্টান সমাজের মনোবল জাগিয়ে রাখা এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন। 

খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগকে আধুনিকীকরণের কাজটিও তাঁর উৎসাহে করা হয়েছিল।

ঐক্য-প্রচেষ্টা ও আন্তঃ ধর্মীয় সংলাপ কমিশনের দীর্ঘ ২১ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তিনি গেছেন আশ্রমে, মন্দিরে, মসজিদে; সংলাপ করেছেন মানুষের সাথে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের সাথে মিশেছেন,সহভাগিতা করেছেন, তাদের অন্তর স্পর্শ করেছেন। যার ফলে দেখা গেছে, অন্যদের সাথে মাওলানা সাহেবও চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিশপ যোয়াকিমের কফিন বহন করেছেন। বলতে শোনা গেছে, আমরা একজন মানব দরদী বিশাল হৃদয়বান বন্ধুকে হারালাম। আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হ’ল।’ বিশপ যোয়াকিম রোজারিও-র স্মরণে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত সার্বজনীন নাগরিক শোক সভার আয়োজন করা হয়। সার্বজনীন নাগরিক শোক সভা-ই প্রমাণ করে বিশপ যোয়াকিম যে সত্যিই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশ মন্ডলীতে বিশপ যোয়াকিম সবচাইতে বড় অবদান রেখেছিলেন তাঁর প্রবক্তার ভূমিকায়। উপযুক্ত সময়ে কারো প্রশংসা বা নিন্দার তোয়াক্কা না করে তিনি অবলীলাক্রমে অপ্রিয় সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেননি। সূফিতত্ত গবেষণা ও মানব কল্যাণ কেন্দ্রে-র অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।

অতি সাধারণ, সাদাসিধে মানুষটি বিশপ হলেও নিজের কোন গাড়ী ছিল না। গাড়িটি তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমার ধর্মপ্রদেশের ধর্মপল্লীগুলো কোনটি পাহাড়ে, আবার কোনটি নদীবেষ্টিত। তাছাড়া গাড়িতে, রেলগাড়ীতে, লঞ্চে সাধারণ মানুষের সাথে চললে, কথা বললে, অনেক কিছু দেখা, শেখা ও জানা যায়। তাই তিনি তাঁর বরিশাল অঞ্চলে গেলে, লঞ্চের কেবিনে না গিয়ে ডেকে সাধারণ লোকদের সাথে গল্প করতে করতে যেতেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে নিজের পরিচয় দিতেন খ্রীষ্টানদের মাওলানা হিসাবে। ধর্ম চর্চা যে বাঙালিত্বের প্রতিদ্বন্দী নয়, বিশপ যোয়াকিম রোজারিও, সিএসসি’র কর্ম ও জীবন সাধনাই তার প্রমাণ।

Add new comment

5 + 5 =