Radio Veritas Asia Buick St., Fairview Park, Queszon City, Metro Manila. 1106 Philippines | + 632 9390011-15 | +6329390011-15
গত ২০ অক্টোবর, ফাদার মারিনোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ প্রার্থনা
মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখাসহ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ফাদার মারিনো গত তিন বছর আগে ২০ অক্টোবর ইতালিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আর তারই সম্মরনে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’প্রাপ্ত ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জনকারী ইতালির খ্রিস্ট ধর্মযাজক ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের স্থাপিত মোংলার সাধু পলের ক্যাথলিক মিশনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
ফাদার মারিনো ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিন্নাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজক হিসেবে তিনি ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অবশেষে তিনি মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে একটি চার্চ ও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওই গ্রামেই তার স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য নিজের প্রতিষ্ঠিত চার্চে গোপনে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। তার এ ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে পুনরায় রণাঙ্গনে ফিরে গেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমও ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মারিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৯ সালে নাগরিকত্ব ও ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করেন।
তাঁর হাত দিয়ে ইতালিয়ান ভাষায় অনুদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা।
ফাদার রিগন প্রথম ইতালীয় অনুবাদক, যিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ সরাসরি বাংলা থেকে ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। একাধিক সংস্করণ হয়েছে গ্রন্থটির।
তাঁর ইতালির অনুদিত রবীন্দ্রকাব্যের একাধিক গ্রন্থ ফ্রেঞ্জ, স্প্যানিশ ও পুর্তগিজ ভাষায় অনুদিত হয়। যা থেকে স্পষ্ট হয় তিনি কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিজ জাতির কাছে নয়, ইউরোপের অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল ভুমিকা।
১৯৯০ সালে তাঁর ভাইবোন ও স্বজনদের উদ্যোগে ইতালিতে প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র অধ্যয়নকেন্দ্র।রবীন্দ্রচর্চা, অধ্যয়ন, প্রচার ও প্রকাশের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনার চিরন্তর দিকগুলো তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অমর বাণী প্রকাশ করাই সংগঠনটির মূলমন্ত্র। রবীন্দ্র কেন্দ্রের তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালিতে একটি সড়কের নামকরণ করেছে রবীন্দ্র সরণি।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই সংস্থা আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে পালন করে রবীন্দ্র উৎসব। রবীন্দ্র কেন্দ্রের আয়োজনে ফাদার রিগন কর্তৃক পরিচালিত শেলাবুনিয়া সেলাইকেন্দ্রের উৎপাদিত নকশিকাঁথার চারটি প্রদর্শনী হয় ইতালির বিভিন্ন শহরে।
বাংলার ঐতিহ্যময় এই শিল্পকর্মটি ইতালির শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে প্রশংসা কুড়ায় দারুণভাবে। ফাদার রিগন হলেন রবীন্দ্র অধ্যয়নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা। ফাদার রিগনের কর্ম পরিধির বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে শিক্ষামূলক কার্যক্রম।
তাঁর হাত দিয়েই মংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পল্স উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। ফাদার রিগনের প্রত্যক্ষ ভুমিকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া হাজার হাজার সুবিধা বঞ্চিত ছেলেমেয়ের স্পন্সরশিপের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোংলার ক্যাথলিক মিশনে থাকাবস্থায় ফাদার রিগনকে তার পরিবার ইতালি নিয়ে যায়। জন্মস্থান ইতালির ভিল্লাভেরলা গ্রামে ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই ধর্মযাজক।
Add new comment