কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

স্বাগত কলকাতার চিঠিতে। আশা করি ভালো আছেন।

কলকাতার হৃদয় বিবাদী বাগ ও তিন বিপ্লবী বীর এবং কর্নেল সিম্পসন বধের তারিখ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। আর এই বিশেষ দিনটি অতিবাহিত হয়ে গেল গতকাল।

কলকাতা শহরের লালদীঘি সংলগ্ন যে এলাকাটি 'অফিস পাড়া' নামে পরিচিত, অনেকে সেটিকে 'কলকাতার হৃদয়' বলেও অভিহিত করেন। কেননা এখানেই যে রয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং, রিজার্ভ ব্যাংক, জিপিও সহ রয়্যাল এক্সচেঞ্জ, টেলিফোন ভবন এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও ব্যাংক। ব্রিটিশ আমলে কাগজে-কলমে কলকাতার এই প্রশাসনিক কেন্দ্রের নাম ছিল ডালহৌসি স্কোয়ার। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর লালদীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এলাকাটির নতুন নাম হয় বিবাদী বাগ। না, কোনো ঐতিহাসিক বিবাদ থেকে এলাকাটির নাম বিবাদী বাগ হয়নি। তবে এর নামকরণের সাথে জড়িয়ে আছে বিবাদের চেয়েও বড় একটি বিষয়: ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের তিন বীর সেনানী - বিনয়, বাদল ও দীনেশের নামের আদ্যক্ষর অনুসারে (বিবাদী) এলাকাটি পেয়েছে তার বর্তমান নাম।

ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ছিল অনেক দিন ধরেই। অর্ডার ছিল এক বিশেষ ভারতীয় তরুণকে যেন তেন প্রকারে সরিয়ে দিতে হবে, অথচ সরকারের যেন কোনও দায় না থাকে। তৈরি করা হ'ল আলিপুর জেলের মধ্যে বিশেষ সেল, সেখানে আগে থেকে ঢুকিয়ে রাখা হ'ল কয়েদি রূপে বাছাই করা গুন্ডাদের আর কি করতে হবে তা আগে থেকেই ট্রেনিং দেওয়া আছে তাদের। এবারে পূর্ব পরিকল্পনা মতো কলকাতা পৌরনিগমের সামনে ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান-মিছিল থেকে মারতে মারতে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় তুলে এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হ'ল আলিপুর জেলে তৈরি করা সেই বিশেষ সেলে (১৯৩০, ৩০ জানুয়ারি)।

কাকে? ভারত মা'য়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান - সুভাষচন্দ্র বসু'কে।

ভয়ঙ্কর অত্যাচারের এই সম্পূর্ণ কাজটি করা হয়েছিল ব্রিটিশ বাংলার কারা-মহাধ্যক্ষ কর্নেল সিম্পসনের পরিকল্পনা ও নির্দেশে। এর পরের ধাপে শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক করতে থাকে ইংরেজ সরকার। একসময় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না। জেলের মধ্যে তৈরি হয় এক অসহ্য দমবন্ধ অবস্থা। রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে তাঁরা জেলের নিয়ম অনুযায়ী নূন্যতম থাকার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ বেদমভাবে লাঠিচার্জ করে (১৯৩০, এপ্রিল)। আর পরিকল্পনা মতো সেইসময় সুভাষচন্দ্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গুন্ডা কয়েদিরা। প্রচণ্ড অমানুষিক মারধরের পর অজ্ঞান সুভাষচন্দ্র'কে মৃত ভেবে গুন্ডা কয়েদিরা ছেড়ে দেয়। মারাত্মক জখম হয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞান অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা সেই সেলে পড়ে রইলেন সুভাষচন্দ্র। ওদিকে অন্য সকল বিপ্লবীদের লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। দীর্ঘ সময় বিনা চিকিৎসার পরেও সুভাষচন্দ্র উঠে দাঁড়ান। এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লো জেলের বাইরেও। জানা গেল এই নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে রয়েছে সেই সিম্পসন।

ভারতবর্ষের প্রতীক সুভাষচন্দ্র বসুর এই রক্তক্ষরণ বিপ্লবীদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না, 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে'র পক্ষে তো একেবারেই না। টার্গেট হ'ল কর্নেল সিম্পসন, সে বসতো 'রাইটার্স বিল্ডিং'-এ। তার নাম তালিকার শীর্ষে ছিল। সিম্পসনের পরে ছিল সেক্রেটারী আলবিয়ানের নাম। তারপর ছিল ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ ক্রেগ ও জুডিসিয়াল সেক্রেটারী নেলসনের নাম। এরা সবাই ছিল নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত পুলিশ অফিসার।

জেল থেকে মুক্তির পরে (১৯৩০, অক্টোবর) সব শুনে প্রথমে পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কারণ তিনি জানতেন এই অভিযান থেকে কেউই ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু ৭নং ওয়ালিউল্লা লেনে 'বিভি'র গোপন হেডকোয়ার্টারে দ্বিতীয়বার আলোচনায় হেমচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে বিপ্লবী কমিটি ব্রিটিশ দম্ভের প্রতীক রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের অনুমোদন দিয়ে দেয়।

তিন বিপ্লবী একরকম জোর করেই নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন দায়িত্ব – ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ারর্সে’র কর্নেল বিনয়কৃষ্ণ বসু, মেজর দীনেশচন্দ্র গুপ্ত ও ক্যাপ্টেন বাদল গুপ্ত। খুব সতর্ক অবস্থায় তাঁদের প্রশিক্ষণের কাজও শেষ হ'ল। ১৯৩০, ৮ ডিসেম্বর এই তিন বিপ্লবী রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ অভিযানে যান। দিনের বেলা, সবার চোখের সামনে ঐতিহাসিক যাত্রা, যা আজও শিহরণ জাগায় মনের মধ্যে। লক্ষ্য সফল হয়। প্রথমেই তিন বিপ্লবীর ছয় গুলিতে সিম্পসন নিহত হয়। যে বিল্ডিং-এ প্রতিটা সেকেন্ড ধরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে, সাধারণ ইংরেজ কর্মচারীরা যেখানে টেবিলের ওপর খোলা পিস্তল রেখে কাজ করে, সেখানে সত্যি যখন দরকার হ'ল, তখন যে যেদিকে পারলো পালিয়ে লুকালো। এরপর তিন বিপ্লবী বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন অফিস ঘর আক্রমণ করেন। নেলসন ও টাইসন সহ অন্যান্য আইসিএস অফিসাররা আহত হয়ে পালিয়ে যায়। আক্রমণের খবর পেয়ে লালবাজার থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে টের্গাড ও অফিসার ক্রেগ আসে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পূর্ব বারান্দায় তিন বিপ্লবী বিনয়, বাদল, দীনেশের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ শুরু হয়। দীনেশ গুপ্তের হাতে গুলি লাগে, তবু তিন বীর সাহসী সৈনিকদের দাপটে পুলিশ বাহিনী পিছু হটে। এরপর গার্ডন আসে সশস্ত্র সৈন্য বাহিনী নিয়ে। কিছুক্ষণ পরে তুমুল গুলির বৃষ্টির সামনে সশস্ত্র সৈন্য বাহিনীও পালিয়ে এদিক-ওদিক লুকিয়ে পড়ে। জনসন নামে এক সেনা কর্তা ভয়ে বড় ড্রেন পাইপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। একসময় বিপ্লবীদের গুলি ফুরিয়ে আসে, তাঁরা বিল্ডিংয়ের ফাঁকা পাসপোর্ট অফিসে ঢুকে পড়েন। মিশন রাইটার্সের নেতা বিনয় বসু অত্যাচারী সিম্পসনকে হত্যা সফল হওয়ায় দীনেশ ও বাদল'কে অভিনন্দন জানান, নিজেদের মধ্যে বিজয় আনন্দ ভাগ করেন, তারপর আত্মহুতির আদেশ দেন। তিন বিপ্লবী শেষবার একে অপরের হাত ধরে 'বন্দেমাতরম্' আওয়াজ তুলে পটাশিয়াম সায়ানাইড এ্যম্পুল খেয়ে নেন। তা সত্বেও বিনয় বসু ও দীনেশ গুপ্ত তাঁদের শেষ বুলেট মাথা ও গলা লক্ষ্য করে চালিয়ে দেন; ফলে সায়নাইডের সায়ানাইডের ফল তাঁদের দেহে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। বাদল গুপ্ত শুধু সায়ানাইডই খেয়েছিলেন, তাই ঘটনাস্থলে মুহূর্তে দেহত্যাগ করেছিলেন।

১৯৬৯, ৮ ডিসেম্বর, বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী স্বদেশী নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে পাল্টে 'বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ' লেখা শিলান্যাস করেন। ১৯৬৯ সালে এই ৮ই ডিসেম্বর যাঁর অনুমোদনে তিন মহান বিপ্লবী রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানে সিম্পসন বধে গিয়েছিলেন, সেই বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ ওই অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করেন।

তথ্যসূত্র: ‘ভারতের সশস্ত্র সংগ্রাম’ - ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়

সুন্দর হোক আপনাদের জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই কলকাতার চিঠিটি পড়ে। তাহলে একটি Like, Comment করবেন এবং আপনার facebook page এ অবশ্যই Share করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

Please Like, Comment and Share this Program

#Rvapastoralcare #RVASocialMedia2018 #4thRvaOnlineTraining #RVA #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService #Chitrabani #চিএবাণী #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #Kolkatar_Chithi

Add new comment

8 + 7 =