করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্যে প্রার্থনায় পোপ মহোদয়ের বাণী ও আশীর্বাদ।

পোপ মহোদয় ২৭শে মার্চ, শুক্রবার, সন্ধ্যা ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত এগারোটায়) গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই প্রার্থনা শুরু করেন। সাধু পিতরের মহামন্দির চত্তর ছিল জনশূণ্য। সাধু লূক রচিত মঙ্গলসমাচারের ৮:২২-২৫ পদে বর্ণিত অংশ থেকে পাঠের শেষে তাঁর নিম্নোক্ত বাণী দেন। তার বাণীতে করোনা ভাইরাসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন, যার মর্মার্থ নিম্নরুপ-

 

বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাসের মহামারী মানবতার উপরে ঈশ^রের কোন বিচার নয়, বরং মানুষের কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই অনুসারে এখন থেকে কি করণীয় তা মনস্থির করতে ঈশ^রের একটি আহ্বান। তিনি সকলকে আহ্বান করে বলেন, এসো আমরা যীশুকে আমাদের নৌকায় আহ্বান করি, আমাদের সকল ভয়-ভীতি তাঁর হাতে সঁপে দেই যেন তিনি সবকিছু জয় করতে পারেন।

 

গালীল সাগরের প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে যীশুর উপস্থিতিতে শিষ্যদের মতো আমরাও নৌকাডুবির বিপর্যয় থেকে রক্ষার পাওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করবো, কারণ ঈশ^রের শক্তি যেখানে উপস্থিত সেখানে আমাদের জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, এমনকি যে কোন ধরণের মন্দতাকেও তিনি উত্তমতায় পরিণত করেন।

 

গালীল সাগরে ঝড়ের ঘটনাটি ঘটেছিল কোন এক সন্ধ্যায়। এই মহামারীর কারণে কয়েক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ্যতা, মৃত্যু, গৃহবন্দী দশা, স্কুল-কলেজ ও কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা যেন সেই সন্ধ্যার অনুভূতি অনুভব করছি। আমাদের চত্ত্বর, শহর ও রাস্তাগুলো যেন গভীর অন্ধকারে পরিণত হয়েছে, আমাদের জীবনের উপরে যেন আবরণ সৃষ্টি করছে, সবকিছু যেন স্তদ্ধ করে দিচ্ছে এবং বর্তমান সময়ের গভীর শুণ্যতা যেন পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে। এসব কিছু আমরা বাতাসের মধ্যে অনুভব করছি, মানুষের আচরণে লক্ষ্য করছি এবং তাদের চাহণির মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি। আমরা যেন ভয়ে দিশেহারা হচ্ছি এবং হারিয়ে যাচ্ছি। মঙ্গলসমাচারের শিষ্যদের মতো আমরা যেন অপ্রত্যাশিত এবং প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেলাম।

 

তবে এই বিশ^ব্যপী ঝড় প্রায় সকলকেই বুঝতে সাহায্য করেছে যে আমরা সবাই একই নৌকায় আছিঃ সকলেই যেন ভঙ্গুর এবং দিশেহারা। তথাপি, সবারই যে ভূমিকা রাখার একটা প্রয়োজন রয়েছে, অন্ততঃ পরষ্পরকে সহায়তা ও সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব। এই পরিস্থিতি আমাদের সেটাই বলে দিচ্ছে।

 

আমরা যে ভঙ্গুর তা এই বিশ^ব্যাপী মহামারী এখন স্পস্ট করে তুলেছে এবং ভ্রান্ত ও অনাবশ্যক যা কিছুর উপরে প্রাধান্য দিয়ে আমরা আস্থা রেখে এতদিন আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়েছি, প্রকল্প তৈরী করেছি, অভ্যাস গড়ে তুলেছি তা এখন খুলে যাচ্ছে। এই ঝড়ের মধ্যে বিশ^াস রাখতে ঈশ^র আমাদের আহ্বান করছেন, এটা কেবল মাত্র তাঁর অস্তিত্বে বিশ^াস করাই নয়, বরং তাঁর দিকে ফিরে তাকানো এবং তার উপরে আস্থা রাখা।

 

প্রায়শ্চিত্তকালের মধ্যে এই মহামারী চলছে যখন ঈশ^র তাঁর ভক্তজনগণকে ‘মন পরিবর্তন’ করে তাঁর কাছে যাওয়ার আহ্বান করেন। এখন সকলের কাছে একসাথে থাকার এবং প্রত্যেকের কাছে সেবার আদর্শ তুলে ধরার সুযোগ এসেছে; এখনই একটু ভিন্নভাবে জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ এসেছে; যারা আত্মদানে ভীত-সন্ত্রস্ত এখন তারাও আগের চেয়ে ভাল করতে পারে, অন্যদেরকে আরও ভালবাসতে ও যত্ন নিতে এই সময়ে বেশী সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যে সব ব্যক্তিদের সেবায় জীবন রক্ষা হয় অথচ তাদের কথা কেউ স্মরণ করে না এবং তাদের সেবাকাজগুলো পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হয় না, পবিত্র আত্মা এই মহামারীর মাধ্যমে তাদের সকলের পরিত্রাণের কাজগুলো দৃশ্যমান করছেন এবং মূল্যবোধগুলোর সাথে আমাদের সকলকে যুক্ত করছেন।

 

ডাক্তার, নার্স, সুপার মার্কেটের কর্মী, পরিচ্ছন্ন কর্মী, সেবাদানকারীগন, পরিবহন কর্মী, আইন-শৃংখলা বাহিনী, স্বেচ্ছাকর্মী, যাজক, সন্ন্যাসব্রতী নারী-পুরুষ এবং আরও অনেকে এখন বুঝতে পারছে যে কেউই একার দ্বারা পরিত্রাণ আনতে পারে না। কতজন এখন প্রতিদিন ধৈর্য্য সহকারে আশার বাণী শোনাচ্ছে, ভীতি না ছড়িয়ে বরং দায়িত্বশীল হতে চেষ্টা করছে। কতজন পিতামাতা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা এবং শিক্ষকমন্ডলী এরকম একটি সংকট মোকাবেলা করতে শিশুদেরকে তাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজকর্মগুলোকে নতুন করে সমন্বয় করতে এবং ঈশ^রের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রার্থনা করতে শেখাচ্ছেন। কত মানুষ এখন প্রার্থনা করছে এবং সবার কল্যাণের চেষ্টা করছে যেগুলো আমাদের বিজয় অর্জনের হাতিয়ার। নৌকায় শিষ্যেরা যখন যীশুকে অনুরোধ করছিলো তখন যীশু তাদেরকে বলেছেন, কেন তোমরা ভয় পাচ্ছো? তোমাদের কি বিশ^াস নেই?

 

এর পরে তিনি ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করে বলেন-

হে প্রভু, এই সন্ধ্যায় তোমার বাণী আমাদের সকলকে স্পর্শ করছে এবং স্বাগতঃ জানাচ্ছে। এই জগতে যেকোন মানুষের চেয়েও তুমি আমাদেরকে বেশী ভালবাস। আমরা বিপদজনক গতিতে এগিয়ে চলেছি, নিজেদেরকে সর্ব ক্ষেত্রে শক্তিশালী এবং সফল মনে করেছি। আমরা লাভের জন্যে লোভী হয়েছি, বিষয় আশয়ের কাছে নিজেদেরকে ধরা দিয়েছি এবং প্রলোভনের টোপ গিলেছি। আমরা তোমার ভৎসনাতেও থেমে যাই নি, বিশ^জুড়ে যুদ্ধ ও অন্যায় আমাদেরকে ঝাঁকুনি দেয়নি, দরিদ্রদের এবং অসুস্থ্য বিশ^-ভ্রম্মান্ডের কান্নাও আমরা শুনতে পাইনি। যে জগত অসুস্থ্য সেই জগতকে অবজ্ঞা করে আমরা এগিয়ে চলেছি।

 

এখন আমরা একটি ঝড়ের সাগরে পড়েছি, আমরা তোমাকে অনুনয় করছিঃ হে প্রভু তুমি ওঠো। তাই তুমিও তোমার জনগনকে বলতে চাওঃ যখন মনে হয়, সব কিছুই শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন সবার সাথে একাত্মতা প্রাকাশ কর এবং পরষ্পরকে আশা-ভরসা দাও। এসবই তোমাদেরকে শক্তিশালী করবে, সমর্থন যোগাবে এবং জীনটাকে অর্থপূর্ণ করবে। প্রভু, তুমি আমাদেরকে জাগিয়ে তুলেছো যাতে আমরা পুনরুত্থানের বিশ^াসকে জাগিয়ে তুলি এবং পরষ্পরকে নতুন জীবন দান করি। ক্রুশ আমাদের নোঙ্গরঃ এই ক্রুশের দ্বারাই আমরা রক্ষা পাবো। ক্রুশ আমাদের পথ-নির্দ্দেশক (রাডার)ঃ এর দ্বারাই আমরা মুক্তি পাবো। ক্রুশ আমাদের প্রত্যাশাঃ এই ক্রুশই আমাদের আলিঙ্গন করছে যাতে আমরা সুস্থ্য হই এবং তাঁর প্রেমপূর্ণ পরিত্রাণ থেকে বঞ্চিত না হই।

 

হে প্রভু, তুমি জগতকে আশীর্ব্বাদ করো, আমাদের সুস্বাস্থ্য দান কর এবং আমাদেরকে সান্ত্বনা দাও। তুমি আমাদের বলেছো যেন ভয় না পাই। তথাপি আমাদের বিশ^াস দুর্বল এবং আমরা ভীত। কিন্তু তুমি, হে প্রভু, আমাদেরকে ঝড়ের হাতে ছেড়ে দিও না। হে সর্বশক্তিমান ও দয়াময় ঈশ^র, তুমি দেখ, তোমার যে সকল ভক্তজনগন এখন অসুস্থ্য ও যন্ত্রণাভোগ করছে তাদেরকে সুস্থ্যতা দান কর। যারা মৃত্যুপথযাত্রী তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর এবং তাদেরকে সান্ত্বনা দাও। হাসপাতালের যেসব স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিতে দিতে এখন বিপর্যস্ত এবং যে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পাচ্ছে তাদেরকে তুমি আশীর্ব্বাদ কর।

 

তুমি এখন আমাদের বিচার করো না, বরং আমাদের নিজেদেরকে যাচাই করার সময় দাওঃ কোন বিষয়ে মনোযোগী হবো এবং কোনটা বাদ দিয়ে দেবো তা যেন বেছে নিতে পারি, কোনটা দরকারী এবং কোন প্রয়োজন নেই তা যেন আলাদা করতে পারি। তোমার দিকে এবং অন্যদের দিকে মনোযোগী হতে আমাদের জীবন যেন সঠিক পথে চালাতে পারি। এই প্রার্থনা করি তোমার পুত্র আমাদের প্রভু, যীশু খ্রীষ্টের নামে। আমেন।

 

পোপ মহোদয়, রোগীদের স্বাস্থ্য এবং ঝড়ের সমুদ্রের তারা কুমারী মারীয়ার প্রার্থনার মধ্যস্থতায়, জগতের সকলকে সাক্রামেন্তীয় আশীর্ব্বাদের মাধ্যমে প্রভুর হাতে সমর্পণ করেন যেন এই আশীর্ব্বাদ সকলের উপরে সান্ত্বনাপূর্ণ আলিঙ্গন হয়ে নেমে আসে। প্রথা অনুযায়ী, পোপ হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার দিনে, প্রতি বড়দিনে ও পুনরুত্থানের দিনে পবিত্র সাক্রামেন্তের মাধ্যমে রোম নগরী এবং সমগ্র জগতকে তিনি আশীর্ব্বাদ প্রদান করেন। ভাতিকান মহামন্দিরের দায়িত্বে নিয়োজিত কার্ডিনাল আঞ্জেলো কোমাস্ত্রি জানিয়েছেন, প্রার্থনার শেষে পোপ মহোদয় সেই একই আশীর্ব্বাদ প্রদান করেছেন যাতে হতাশাগ্রস্থ, গৃহবন্দী, অসুস্থ্য ও মৃত্যুপথযাত্রী যেসকল খ্রীষ্টভক্ত রেডিও শুনে, ইন্টারনেটে এবং টেলিভিশনে দেখে তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে প্রার্থনায় যোগ দিয়েছেন তারা সকলে পূর্ণ দন্ডমোচন লাভ করেন। পূর্ণ দন্ডমোচনের অর্থ হলো ইহকালের যেসব পাপের ফলে শাস্তি প্রাপ্য সেইসব পাপ থেকে ক্ষমা লাভ করা। তবে যেসব খ্রীষ্টভক্ত পাপের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার সাধনা করে, পরবর্তীকালে সুযোগ হলে পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহন ক’রে খ্রীষ্টপ্রসাদ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় এবং পোপ মহোদয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রার্থনা করে তারাই এই ক্ষমা লাভ করেন।

 

অনুবাদক:

বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি, বিশপ, বরিশাল কাথলিক ডাইওসিস, বাংলাদেশ, ২৮/০৩/২০২০

Add new comment

1 + 8 =