কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

 

স্বাগত জানাই ‘কলকাতার চিঠিতে’। আশা করি ভালো আছেন।

 

আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই ভারতবর্ষের এক অজানা এবং ভীষণই কম আলোচিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের একটি অধ্যায় যা জানলে গর্ব হয়, অবাক ও হই, আসে মুগ্ধতা।

 

ভারতবর্ষের সর্ব কনিষ্ঠ শহীদ হলেন বাজি রাউত। তিনি ভারতের উড়িষ্যা নিবাসী ছিলেন।  

 

বাজি রাউত এর নির্মম নিষ্ঠুর মৃত্যুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন কবি সচ্চিদানন্দ রাউত রায় ।

“নুহেন বন্ধু নুহেনেহা চিতা,

এ দেশ তিমির তালে এয়ালিভা,

মুকাতি সালিতা।”

এই অংশের ইংরেজি অনুবাদ ১৯৪২ সালে করেছিলেন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা হারীন্দ্রনাথ চট্ট্যোপাধ্যায় l 

- "It is not a Pyre, O Friends! When the country is in dark despair, it is the light of 

our liberty. It is our freedom - fire"

- এই কবিতাবলী উড়িষ্যা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ l 

 

১৯২৬ সালের ৫ই অক্টোবর উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলের প্রত্যন্ত গ্রামে বাজি রাউত এর জন্ম হয় l তার পিতা ছিলেন নীলকণ্ঠপুরের মাঝি l ব্রাহ্মণী নদীতে যাত্রী পারাপার করতো তার নৌকো l সামান্য পারাপার করার অর্থেই তাদের সংসার চলতো l পিতার মৃত্যুর পর মা দিনমজুরি খাটতেন, ছোট্ট বাজি নৌকা পারাপার করতো l সেই সময় ঢেঙ্কানলের রাজা ছিলেন - শংকর প্রতাপ সিং দেও। তিনি ছিলেন অসম্ভব অত্যাচারী রাজা। যেন তেন প্রকারে প্রজাদের সামান্য সম্পত্তিটুকুও লুঠ করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য l তার অত্যাচারে ওই অঞ্চলে – প্রায় ‘আতঙ্কের শাসন’ চলছিল। দিন মজুরদের মজুরি কেড়ে নেওয়া, অবাধ্য হলেই রাজার হাতির সাহায্যে প্রজাদের ঘর বাড়ি ভেঙে দিয়ে, জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে তছনছ করা হতো l বাজি রাউত এর মা ও এর কবল থেকে রক্ষা পান নি। কাজেই ছোট্ট বাজির মধ্যে প্রথম থেকেই শোষনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বীজ সুপ্ত অবস্থায় ছিল l 

 

শ্রী বৈষ্ণব চরণ পট্টনায়ক ছিলেন ঢেঙ্কানলের এক রেলওয়ে কর্মী l রেলওয়ে পাশের সুবাদে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সহজে যাওয়া আসা করতেন। সেই সুবাদে সর্বত্রই দরিদ্র প্রজা সাধারণের ওপর রাজার ভয়ঙ্কর অত্যাচার দেখেছিলেন l এরপরই  তিনি নিজেকে বিপ্লববাদে দীক্ষিত করেন। সেই সময়ের ‘The Krushaka Journal’ পত্রিকার সাথে যোগাযোগ করেন। ক্রমে তিনি স্থানীয় নেতা হরমোহন পট্টনায়েকের ‘প্রজামণ্ডল দল’ এর সাথে যুক্ত হন l পরে এটি ‘Party Of The People’ দল নামেও পরিচিতি লাভ করে l এই দল স্থানীয় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে l ঢেঙ্কানলের রাজার ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি National Congress of Cuttack এর সাথে যোগাযোগ করেন l ক্রমে বৈষ্ণব চরণ প্রজা সাধারণের কাছে ‘বীর বৈষ্ণব’ নামে পরিচিত হন l ছোট ছেলেদের তিনি রাজা শংকর প্রসাদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত করেন এবং ছোটদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বানর সেনা’ l ছোট বাজি রাউত সেই সেনাদলে যোগ দিয়েছিলো l 

 

এদিকে রাজা ছিলেন ইংরেজ সরকারের বন্ধু। কোন ভাবেই প্রজাদের ছোট খাটো বিদ্রোহ সামলাতে না পেরে তিনি প্রতিবেশী রাজা ও ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন l বালানগিরের রাজা আর. এন. সিং দেও, কালাহান্ডির রাজা পি. কে. দেও এবং ইংরেজ সরকার কলকাতা থেকে এক পল্টন সেনা ও ২০০ জন বন্দুকধারী সেনা ঢেঙ্কানলকে সাহায্য পাঠায়। এই বিশাল সেনাদলের খরচ খরচা বহন  করার জন্য রাজা প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপান, যা ‘রাজভক্ত কর’ নামে পরিচিত হয় l বীর বৈষ্ণব এই কর না দেওয়ার জন্য প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ করেন l প্রজারা ওই কর দিতে রাজি না হলে, তাদের ওপর অত্যাচার শুরু হল। হাতির সাহায্যে ঘরবাড়ি, ধন সম্পত্তি ধ্বংস করা হল l বীর বৈষ্ণবকে গ্রেপ্তার করার জন্য চারদিকে রাজা লোক পাঠায়  কিন্তু তাঁর সন্ধান না পেয়ে হরমোহন পট্টনায়ক ও অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় l

 

এই সময় খবর পাওয়া যায় যে বীর বৈষ্ণব ভুবন গ্রামে আছেন এবং গ্রামবাসীরা তাকে লুকিয়ে রেখেছেন l সেই অপরাধে গ্রামবাসীদের ভয়ঙ্কর ভাবে অত্যাচারিত করা হয় l অবশেষে  জানা যায় বীর বৈষ্ণব কোনও ভাবে ব্রাহ্মণী নদী সাঁতরে ওপারে পালাতে পেরেছেন l

 

১৯৩৮ সালের ১১ই অক্টোবর ছিল সেই ভয়ঙ্কর রাত l রাজা ও ইংরেজ সেনা যেকোনো মূল্যে বিদ্রোহ দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে তারা নদীর তীরে এসে পৌঁছয় l সেই সময় বাজি রাউত খেয়া পারের দায়িত্বে ছিল। সে জানতো বীর বৈষ্ণবকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতেই হবে। কাজেই সময় দীর্ঘায়িত করার জন্য ব্রিটিশ সেনার কথা সে কানে তোলেনি। ফলে অসহিষ্ণু এক সেনা তার মাথায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে l বাজি রাউত চিৎকার করে গ্রামবাসীদেরকে সেনাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করতে থাকে। তখন দ্বিতীয় একজন সেনা বাজি রাউতের মাথার খুলি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়। শেষে তৃতীয় এক সেনা গুলি করে বীর বাজি রাউতকে ভূলুন্ঠিত করে l এই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা আরো চারজন বিদ্রোহী ছুটে গ্রামবাসীকে জানাতে গেলে - ইংরেজ সেনা বাহিনীর গুলির আঘাতে তাঁরাও মারা যান l এই সুযোগে নৌকো দখল করে ইংরেজ সেনারা ব্রাহ্মণী নদী অতিক্রম করার চেষ্টা করে এবং সেই সঙ্গে চলতে থাকে তাদের তুমুল গুলি বর্ষণ l 

 

কবি সচ্চিদানন্দ রাউত রায় লিখেছেন, "but the story does not end here. Baji Rout, Hurushi Prodhan, Lakshmon Mullick, Raghu Nayak, Guri Nayak, Nata Mullick and Fagu Sahu were among the brave deads who fell martyrs to imperialist bullets. The dark lonely night of a still darker land witnessed the martyrdom of ‘Seven’ tall fighters of our land and every one of them a Hero."

 

এরপর বাজি রাউত ও শহীদদের মৃতদেহ রাজধানী কটকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ময়না তদন্ত করা হয়। হাজার হাজার মানুষ তার শেষ কৃত্যে অংশ গ্রহণ করেন l শোকাহত মানুষ সেদিন স্লোগান দিতে থাকেন – “বাজি রাউত অমর।”

 

আজও হয়তো ব্রাহ্মণী নদীর বুকে কান পাতলে শোনা যাবে ভারতের সর্ব কনিষ্ঠ শহীদ বাজি রাউত এর প্রতিবাদী কণ্ঠ – “আমার এই নৌকা প্রজামণ্ডলের। এ নৌকা তোমাদের কখনোই ভাড়া দেওয়া যাবে না। তোমরা মানুষের শত্রু”  

 

তথ্যসূত্রঃ- The Boat Man Boy And Forty Poems – সচ্চিদানন্দ রাউত রায়

আজ এখানেই শেষ করি কলকাতা থেকে লেখা এই চিঠি। সুন্দর হোক আপনার জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে, সুস্থ থাকুন।

 

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা।

তাং: ১৭ মার্চ ২০২১

 

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই ‘কলকাতার চিঠি’ পড়ে। আর পড়ে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি  Like, Comment  করবেন এবং আপনার  facebook page এ  Share করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

 

Please Like, Comment and Share this Program

#Rvapastoralcare #RVASocialMedia2018  #4thRvaOnlineTraining  #RVA  #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService  #Chitrabani #চিএবাণী #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #Kolkatar_Chithi #শহীদ #বাজি_রাউত  #Martyr #Baji_Rout #Odisha #freedomfighter

Add new comment

9 + 1 =