কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

স্বাগত জানাই ‘কলকাতার চিঠিতে’। আশা করি ভালো আছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চেনেন না এমন মানুষ দুই বাংলায় খুব কমই আছেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান ছিল এই অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্বর্তী বনমালীপুর গ্রাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিয়ে প্রচলিত আছে নানা ঘটনা। এগুলোর সত্যতা কতটুকু তা নির্ণয় করা এখন কঠিন তবে ঘটনাগুলো লোক মুখে প্রচার ঘটেছে অনেক। ঘটনাগুলো বেশ মজারও।   

সময়টা তখন ছিল ব্রিটিশ শাসনের। স্থান কলকাতা শহর। -

একবার বিদ্যাসাগর মহাশয়কে একজন বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত বাঙালি ভদ্রলোক নিমন্ত্রণ করলেন। নিমন্ত্রণে যাওয়ার জন্য ভীষণভাবে ভদ্রলোক অনুরোধ করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও যাবেন বলে কথা দেন। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট খ্যাতি, নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে পণ্ডিত মানুষ হিসাবে।

নিমন্ত্রণের দিন সন্ধ্যেতে যথারীতি বিদ্যাসাগর মহাশয় ধোপদুরস্ত সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবী পরে উপস্থিত হন গৃহস্বামীর বাড়ির মূল দ্বারে। বাড়ির দ্বার দিয়ে ঢুকতে যাবেন ঠিক সেই সময়ে দ্বার রক্ষী পথ আটকে বললো, “ইউরোপীয় পোশাক ছাড়া ভেতরে ঢোকা নিষেধ আছে।“ বিদ্যাসাগর মহাশয় দ্বার রক্ষীকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যান।

অল্প কিছু সময় পর বিদ্যাসাগর মহাশয় আবার এসে উপস্থিত হন। তবে এবারে তাঁর পরিধানে সম্পূর্ণ ইউরোপীয় পোশাক। দ্বার রক্ষী কোন কথা না বলে, বরং এক গাল হেসে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভেতরে প্রবেশ করতে দিলো শুধু নয়, গৃহকর্তাকে গিয়ে খবরও দিয়ে এলো যে বিদ্যাসাগর মহাশয় এসে উপস্থিত হয়েছেন। গৃহকর্তা প্রায় ছুটতে ছুটতে বাইরে বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন করজোড়ে।

আহার করতে বসে দেখা গেল বিদ্যাসাগর মহাশয় খাবার বস্তুগুলো চামচে এক এক করে তুলে তাঁর ইউরোপীয় পোশাকের ওপর ফেলতে লাগলেন। নিমন্ত্রিত অথিতিরা আরও দেখে অবাক হলেন যে তিনি তাঁর পোশাকের সঙ্গে কথা বলছেন এবং জানতে চাইছেন কোন কোন খাবারটি আর একটু দরকার।

এই দেখে গৃহকর্তা ছুটে এলেন জানতে যে কি হয়েছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন একটু মুচকি হাসি হেসে বললেন, “এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে নিমন্ত্রিত আমি নই, নিমন্ত্রিত আমার এই বিশেষ পোশাকটি।“

বিদ্যাসাগর মহাশয় পরিষ্কার একটি বার্তা দিয়ে দিলেন এর থেকে যে, ব্রিটিশরা ভারতের ভুমি হয়তো দখল করেছে ঠিকই, তবে ভারতীয়রা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গর্ব নিয়ে ভারতীয় হয়ে থাকতে পারেন।

এঁড়ে  বাছুর হয়েছে -

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের সময় তাঁর বাবা বাড়িতে ছিলেন না। তিনি পাশের গ্রামে হাটে গিয়েছিলেন। ছেলেকে এই সুসংবাদ জানাতে উৎফুল্ল ঠাকুর্দাদা ছুটলেন হাটের দিকে। পথের মধ্যে ছেলের সাক্ষাৎ পেয়ে বললেন, “আমাদের একটি এঁড়ে বাছুর হয়েছে।“ সে সময় বাড়িতে একটি গরু ছিল; তারও দু'একদিনের মধ্যে প্রসবের সম্ভাবনা ছিল। বিদ্যাসাগরের বাবা সে কথা বিশ্বাস করে বাড়িতে ঢুকেই গোয়াল ঘরের দিকে চললেন। তখন বিদ্যাসাগরের দাদু ছেলেকে থামিয়ে রহস্যের হাসি দিয়ে বলে ওঠেন, “ও দিকে নয়, এদিকে এসো, আমি তোমাকে এঁড়ে বাছুর দেখিয়ে দিচ্ছি”, বলে সূতিকা গৃহে নিয়ে গিয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিয়ে দিলেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয় পরে এক কথা প্রসঙ্গে উপহাস করে বলেন, “পিতামহদেব পরিহাস করিয়া আমায় এঁড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন। তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন। তাহার পরিহাস বাক্যও বিফল হইবার নহে। আমি যে ক্রমেই এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুয়ে হইয়া উঠিতে ছিলাম তাহা বাল্যকাল হইতেই আমার আচরণে বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।”

সরস্বতীর স্তব -

একবার এক শিক্ষক সরস্বতী পূজা উপলক্ষে ছাত্রদের একটি শ্লোক লিখতে বললেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখলেন -  

“লুচি কচুরী মতিচুর শোভিতং,

জিলিপি সন্দেশ গজা বিরাজিতাম।

যস্যাঃপ্ৰসাদনে, ফলারমাপ্নুমঃ,

সরস্বতী সাজয় তান্নিরূন্তরম।“

অবতার -

একদিন ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের কাছে এক গোঁড়া ব্ৰাহ্মণ দেখা করতে এসেছেন। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কেউই এই অপরিচিত ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণাম করলেন না। এই ব্যবহারে ব্ৰাহ্মণ অপমানিত বোধ করলেন। অপমানের জ্বালা মেটাতে উপস্থিতদের লক্ষ্য করে বললেন, এইসব অর্বাচীনদের মনে রাখা উচিত যে, ব্ৰাহ্মণেরা বর্ণ শ্রেষ্ঠ, বেদজ্ঞ। এক সময় তারা দেশ ও ধর্মের কল্যাণ সাধন করেছেন। তারা সব সময় সকলের প্ৰণম্য। একথা শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় হেসে বললেন, “পণ্ডিতমশাই, শ্ৰীকৃষ্ণ একদিন বরাহরূপ (শূকরের চেহারা) ধরেছিলেন বলেই কী ডোম পাড়ায় যত শূকর আছে, তাদের প্রণাম করতে হবে?”

বই ও শাল -

একবার এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি ভদ্রলোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। বিদ্যাসাগরের প্ৰিয় শখ ছিল বই পড়া এবং সেগুলো যত্ন করে বাঁধাই করে রাখা। এই কাজে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয়ও করতেন। ভদ্রলোক বইগুলো দেখে বললেন, “এরূপ এত খরচ করে বইগুলো বাঁধিয়ে না রাখলেও হতো।“

বিদ্যাসাগর বললেন, “কেন? এতে দোষ কী?”

ভদ্রলোক বললেন, “ঐ টাকায় অনেকের উপকার হতে পারতো।“

বিদ্যাসাগর তামাক খেতে খেতে ভদ্রলোকের শাল লক্ষ্য করে বললেন, “আপনার শালটি মশাই চমৎকার তো। কোথা থেকে, কত দিয়ে কিনেছেন?”

শালের প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, শালটি পঁচিশ টাকায় খরিদ করা। বিদ্যাসাগর সুযোগ পেয়ে বললেন, “পাঁচ সিকের কম্বলেও তো শীত কাটে, তবে এত টাকার শালের প্রয়োজন কী? এ টাকায়ও তো অনেকের উপকার হতে পারতো।“

পয়সার গরম -

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন। শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বরচন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে হিন্দু কলেজেরই এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য প্রায়ই বলতেন, “কিহে, বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর প্রতিদিন কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একই ভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। তাঁর যাওয়ার পথের মাঝে আবার সেই ইংরেজের সাথে দেখা। আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চন্দ্র তাঁর ধুতির কোঁচড় থেকে একটা কয়েন বের করে বললেন, “এই যে গুজে রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগে না। এবার হলো তো?”

আজ এখানেই শেষ করি কলকাতা থেকে লেখা এই চিঠি। সুন্দর হোক আপনার জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে, সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা।

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই ‘কলকাতার চিঠি’ পড়ে। আর পড়ে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি  Like, Comment  করবেন এবং আপনার  facebook page এ  Share করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

Please Like, Comment and Share this Program

#Rvapastoralcare #RVASocialMedia2018  #4thRvaOnlineTraining  #RVA  #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService  #Chitrabani #চিএবাণী #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #Kolkatar_Chithi #ঈশ্বরচন্দ্র_বিদ্যাসাগর #Iswarchandra_Vidyasagar

Add new comment

20 + 0 =