কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

স্বাগত জানাই ‘কলকাতার চিঠিতে’। আশা করি ভালো আছেন।

আজ চলুন আমরা সবাই যাই বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় বাড়ি, পশ্চিমবঙ্গের সামতাবেড় গ্রাম, দেউলটি, হাওড়াতে।

অতি সম্প্রতি ঘুরতে ঘুরতে এইখানেই পৌঁছে গেলাম একদিন। এত দর্শনার্থীর সমাগম যে তার মধ্যে Video ধারণ করা হয়ে উঠলো কঠিন। কিন্তু সেখানকার কথা আপনাদের না জানিয়েও থাকতে পারছি না। তাই আজ এই ‘কলকাতার চিঠি’।

বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান হুগলি জেলার দেবানন্দপুর হলেও সেখানে তিনি বেশিদিন থাকেন নি। দেবানন্দপুর শরৎচন্দ্রের জন্মভূমি হলেও পিতৃভূমি নয় ৷ এরপর অবশ্য তিনি ছিলেন বিভিন্ন জায়গায়। যেমন পিতার কর্মসূত্রে স্বল্পকাল বিহারের শোন নদী তীরবর্তী ডেহরিতে কাটিয়ে ভাগলপুরে চলে আসেন ৷ তারপর আবার দ্বিতীয় বারের জন্য দেবানন্দপুরে আসেন। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি রেঙ্গুনেও যান। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নাগাদ অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে এসে তিনি ভাড়া নিলেন হাওড়া শহরের বাজেশিবপুর অঞ্চলের একটি বাড়ি ৷ বাজেশিবপুরে থাকার শেষ দিকে সম্ভবত তিনি শহর জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে আগ্রহী হয়েছিলেন ৷ তাই কোলাহলহীন কোনও নির্জন গ্রামে গিয়ে থাকতে মনস্থ করেন ৷ কিন্তু তেমন গ্রাম আর কোথায়? শৈশব ও কৈশোরের কিছুকাল যে দেবানন্দপুরে কেটেছিল, আর্থিক কারণে পিতা মতিলাল তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন ৷ সেই বাড়ি অন্যের হাত থেকে উদ্ধার হওয়াও ছিল অসম্ভব ৷ খোঁজ করতে থাকেন একটা আপাত নির্জন গ্রাম, যেখানে তিনি নিজের মনের মতো বাড়ি তৈরি করে কাটাবেন শেষ জীবন ৷ শরৎচন্দ্রের বড় দিদি অনিলাদেবীর শ্বশুরবাড়ি ছিল হাওড়া জেলার বাগনান অঞ্চলে ৷ সেই সূত্রে পার্শ্ববর্তী দেউলটি অঞ্চলে সামতাবেড়ে একটা জমি পছন্দ হয় তাঁর ৷ সেখানেই মাঠ, ধানজমি, পুকুর - সহ একটা বাড়ি তৈরি করিয়ে বাজেশিবপুরের পাঠ তুলে ১৯২৬ থেকে সেখানে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন ৷ জীবনের একেবারে শেষ পর্বে কলকাতায় আসার সময়টুকু বাদ রাখলে শরৎচন্দ্র বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন সামতাবেড়ের গ্রামে ৷

মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র দেউলটির সামতাবেড় গ্রামে এই মাটির বাড়িতে বাস করতেন। দক্ষিণপূর্ব রেলের দেউলটি ষ্টেশন থেকে চার – পাঁচ কিলোমিটারের পথ সামতাবেড়ের বাড়িটা রুপনারায়ণ নদীর তীরে এক অতীব মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। পাশাপাশি দুটো পুকুর, স্নানের ঘাট, বাগান – ডালিম, পেয়ারা, আম, বাঁশ, নারকেল, সুপারি গাছে ঘেরা। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের প্রবল বন্যায় গ্রামের সব বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তাঁর বাড়িটি ছিল সুরক্ষিত। রক্ষ্যা পেয়ে যায় রুপনারায়ণের করাল গ্রাস থেকে। ভীত থেকে জানলা অবধি ইঁট – সিমেন্টে গাঁথা ছিল বলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাড়িটি পড়ে যায়নি। বর্তমানে একজন কেয়ারটেকার বাড়িটির দেখাশোনা করেন। শরৎচন্দ্র নিজের জীবনের বেশ অনেককাল বার্মাতে কাটিয়েছেন। তাঁর বার্মার প্রতি প্রেম এই বাড়িটিকে দেখলেই বোঝা যায়। পুরো বাড়িটা দেখতে এবং তার ব্যবহারিক জিনিসে বার্মার ছাপ সুস্পষ্ট। বাড়িটি টালির চাল দেওয়া দোতলা যা এখনও রয়েছে স্বমর্যাদায় ৷ সামতাবেড়ে তাঁর এই বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর। ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই বাড়িটিকে ঐতিহ্য স্মারকের মর্যাদা দিয়েছে ৷

এখানে থাকাকালীন তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘পথের দাবী’ উপন্যাস ৷ ১৯২৬ এর অগাস্টে ‘পথের দাবী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়া মাত্রই আলোড়ন তুলে দিল বাঙালি সমাজে ৷ জীবনীকারেরা কেউ কেউ জানিয়েছেন, মাত্র কয়েক দিনেই ‘পথের দাবী’র পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায় ৷ কিন্তু উপন্যাসের এই জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ সরকার ভালো চোখে দেখল না ৷ বাজেয়াপ্ত হল ‘পথের দাবী’৷ শরৎচন্দ্র তাঁর জীবদ্দশায় সে বইয়ের রাহু মুক্তি দেখে যেতে পারেননি ৷ শরৎচন্দ্র ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ সাল মানে দীর্ঘ ১২ বছর এখানে থাকাকালিন অনেক উপন্যাস ও ছোটগল্প এখানে বসেই লেখেন যার মধ্যে উল্লেখ্য বিপ্রদাস, মহেশ, দেবদাস, অভাগীর স্বর্গ এবং রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত-র অন্তিম পর্ব এখানে বসেই লেখা।

এই বাড়িতে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত অনেক জিনিস রয়েছে ৷ একতলার ঘরে রয়েছে শরৎচন্দ্র ব্যবহৃত লেখার টেবিল, বইয়ের ছোটো বুকসেল্ফ, বিছানা ৷ এ ছাড়াও বিভিন্ন ঘরে যত্ন নিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে তাঁর জুতো, চরকা - সহ আরও অনেক সামগ্রী ৷ বাড়ির পাশেই রূপনারায়ণ নদী মুখী দোতলার ঘরে শরৎচন্দ্রের লেখার ঘর ও চেয়ার–টেবিল ৷ আর দেখা যায় তাঁর শোবার ঘর, রুগী দেখার ঘর (তিনি হমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন ও গরীবদের বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন) এবং বৈঠকখানা ঘর ৷ এছাড়াও আছে তার ব্যবহারের রেডিও,তামাক-গড়গড়া এবং নানা বই। এসব দেখতে দেখতে মনে হল, সময় যেন এখানে সত্যি হঠাৎ থেমে গিয়েছে। সম্পূর্ণ এক শান্তির অনুভুতি পুরোপুরি আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেললো যা ভাষায় বোঝানো কঠিন।

বুড়ো কেয়ারটেকার পুরো বাড়িটি খুব পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছেন। তিনি ওখানে আগত অতিথিদের সাথে করে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের বাড়ি দেখান এবং তার জীবনের অনেক গল্প বলতে থাকেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের তার বাড়িতে নৌকা করে আসা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের দেওয়া রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ যা এখনও পূজিত হয় এই বাড়িতে। গান্ধীজির দেওয়া চরকা সেটিও রয়েছে অটুট এই বাড়িতে। কত ইতিহাসের হদিস চুপচাপ দিয়ে চলেছে দেউলটিতে বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই দোতলা বাড়িটি। শরৎচন্দ্রের এই বাড়ির পাশ দিয়েই বহমান রূপনারায়ণ নদী। জানলাম যে এই পথেই নাকি অনেক বিপ্লবী ও সেই সময়কার জাতীয়তাবাদী নেতারা নদীপথে ওঁনার সাথে দেখা করতে আসতেন।

বাড়ির বাইরে ওঁনার, ওঁনার স্ত্রী হিরন্ময়ী দেবী এবং ওঁনার ভাই রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড় মঠের মহারাজ স্বামী বেদানন্দের সমাধিতে বিনম্র প্রণাম জানিয়ে ফিরে আসা।

 

আজ এখানেই শেষ করি কলকাতা থেকে লেখা এই চিঠি। সুন্দর হোক আপনার জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে, সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা।

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই ‘কলকাতার চিঠি’ পড়ে। আর পড়ে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি  Like,  Comment  করবেন এবং আপনার  facebook  page  এ  Share  করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

Please Like, Comment and Share this Program

#Rvapastoralcare #RVASocialMedia2018  #4thRvaOnlineTraining  #RVA  #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService  #Chitrabani #চিএবাণী #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #Kolkatar_Chithi #Saratchandra_Chattopadhay #Samtaberh #Deulti #Howrah #শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় #সামতাবেড় #দেউলটি #হাওড়া

Add new comment

9 + 11 =