কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

স্বাগত জানাই ‘কলকাতার চিঠিতে’। আশা করি ভালো আছেন।

আজ চলুন আমরা সবাই যাই ‘বিবর্তনের সন্ধানে’। সময়টা ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে । প্রেক্ষাপট কলকাতা শহর।

 

অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন রাজা। বড় হতাশ লাগছে তাঁর। মানুষই যদি বিরোধিতা করে, তাহলে তিনি লড়বেন কাদের নিয়ে? আর করবেনই বা কাদের জন্য? ধুস, আর লড়াই করে লাভ নেই!

এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, “একজন ব্রাহ্মণ মশাই দেখা করতে চাইছেন। দেখে মনে হচ্ছে খুব গ্রাম থেকে আসছেন। “

একটু বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “এখন আমার সময় নেই বলে দে।“

দারোয়ান বলল, “বলেছি। কিন্তু উনি যেতে চাইছেন না।“

তখন রাজা বললেন, “পাঠিয়ে দে।“

 

এক ব্রাহ্মণ ঘরে ঢুকলো। খাটো ধুতি, গায়ে নামাবলি, মাথায় টিকি। টিকি দেখলেই রাজার মাথাটা যায় গরম হয়ে।

রুক্ষস্বরে বললেন, “কী চাই?”

ব্রাহ্মণ বলতে শুরু করলেন, “আমি টিটাগড়ের শ্যামল ভট্টাচার্য।“ থামলেন, বোধহয় গুছিয়ে নিলেন নিজেকে একটু। আবার শুরু করলেন, “জানেন, সেদিন ছিল বৈশাখ মাস। টোল থেকে ফিরতেই সুমিত্রা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে। জল দিলো, গামছা দিলো, বাতাস দিলো পাখা করে। আমার জন্য তার যত চিন্তা। বাপে মেয়েতে আদর খাচ্ছি। তখন ওর মা ডাকলো ঘর থেকে।“

ভেতরে যেতে বলল, “মেয়ের তো ৭ বছর বয়স হল। আর কত দিন ঘরে বসিয়ে রাখবে? পাড়ায় যে কান পাতা দায়।“

আমি বললাম, “পাত্র পাচ্ছি কই? যার কাছেই যাই ১০০০ টাকার কমে, পণ নেবে না কেউ।“ বন্দনা ফিসফিস করে বলল, “সবার তো কপাল সমান হয় না। কিন্তু জাত ধর্ম তো রাখতে হবে। কাল নদী পথে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ এসেছেন। বয়সটা বেশি। ৭০এর ঘরে। কিন্তু বংশ উঁচু। ৫০টাকায় কন্যা উদ্ধার করেন তিনি। আমাদের সুমিত্রাকে ওর হাতে গৌরী দান করো।“

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘না, না… এ হবে না !‘

 

শ্যামল ভট্টাচার্য মশাই একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, “কিন্তু সমাজের চাপ তো বুঝি। বুঝি সংসারের চাপও। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে সুমিত্রা’র সাথে বিবাহ দিলাম। লাল চেলি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়েকে আমার দেবীর মতো লাগছিলো। সে যে কী রূপ কী বলবো...! বোধহয় বাপের নজরটাই লেগেছিল সেদিন। পরদিনই মেয়েকে ছেড়ে জামাই বাবাজীবন আবার পাড়ি দিলেন নদী পথে। আরও কারোর কন্যা উদ্ধার করতে। বলে গেলেন, ‘আবার আসবো পরের বছর।‘ আমাদের বাপ মেয়ের আনন্দের জীবন চলছিলো বেশ। সারাক্ষণ  আমার পেছনে। সব কাজ শিখে গেল। পারতো না শুধু রান্না। একদিন হাতে ফোস্কা পড়ে সে কী অবস্থা ! আমি ওর মাকে বলে দিলাম, ওকে রান্নার কাজে লাগাবে না। আগুনে ওর কষ্ট হয়। কী খুশি সেদিন মেয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত আদর।“

 

ভট্টাচার্য মশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “আশ্বিন মাস গড়িয়ে যায়। পুজো আসছে, চারদিকে সাজো সাজো রব। আমি হাট থেকে মেয়ের জন্য লাল টুকটুকে শাড়ি, আলতা সব নিয়ে এলাম। মেয়ে খুব খুশি। বলল, ‘ওঃ ! কখন যে পড়বো এইসব। বাবা, আমাকে রানীর মতো লাগবে, বলো?’ আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠলো। অভাবী সংসারে খুশি উপচে পড়লো। ঠিক তার পরের দিন, জানেন, ঠিক পরের দিন। সকাল দশটা হবে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এলো পত্র নিয়ে। গতকাল নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় দেহ রেখেছেন। যথাবিহিত বিধি অনুসারে কন্যাকে সতী করার নির্দেশ দিয়েছেন তারা। ভেবেছিলাম, পত্র ছিঁড়ে ফেলবো। কিন্তু পত্রবাহক গ্রামের মাতব্বরদের জানিয়েই এসেছেন আমার বাড়ি। কোন উপায় ছিল না।“

 

রাজা বলে উঠলেন “তারপর?”

ভট্টাচার্য মশাই বলতে শুরু করলেন, “তারপর মেয়েকে সাজালাম। নতুন লাল চেলির শাড়ি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়ে সেদিন অপরূপা। গ্রামে উৎসব, কাঁসর, ঢাক বাজছে। এয়োরা সবাই ওর মাথার সিঁদুর, ওর আলতা নিচ্ছে। আর ও নিজে কী খুশি সেজেগুজে। ওর পছন্দের দই, মিষ্টি নিয়ে এসেছি ঘর ভরে। জানেন, তার মধ্যেও, ও সেসব আমাকে খাওয়াবে বলে ব্যস্ত।“ কথা বন্ধ হয়ে আসে শ্যামল ভট্টাচার্যের। চোখটা মুছে আবার শুরু করেন, “খালি সে বুঝতে পারেনি উৎসবটা কিসের। এরপর খবর এলো নদীর তীরে চিতা সাজানো সমাপ্ত। সতী মাতাকে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন কুলীন সমাজ। মেয়েকে কোলে নিয়ে চললাম। কাঁদিনি একটুও। ওকে বুঝতে দিতে চাইনি কিছুই। চিতার পাশে সমস্ত আনুষ্ঠানিক কাজ মিটলো। মেয়ে অবাক হয়ে দেখছিল সব।

 

আগুন দেওয়া হল চিতায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো চিতা।“

মেয়ে বলল, “বাবা, বাড়ি চলো। আগুনে আমার বড় ভয় লাগে !“  

আমি বললাম, “আমার গলাটা একবার ছাড় মা।‘

কচি হাত দুটো গলাটা ছাড়তেই; ছুঁড়ে দিলাম অগ্নিকুণ্ডে। আগুনের মধ্যে থেকে একটা রিনরিনে গলা পাওয়া গেল, ‘বাবা-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ! সেই ডাক আমি ভুলতে পারিনি।‘  ভট্টাচার্য মশাই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। গলা তার ধরে এলো। কোনরকমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ভট্টাচার্য মশাই আবার শুরু করলেন, “তারপর থেকে একদিনও রাত্রে ঘুম হয়নি। উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে, শুধু এক আওয়াজ, ‘বাবা-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ-আ !’ আমি পারিনি তাকে বাঁচাতে। আপনি পারেন। পায়ে ধরি আপনার। মেয়েগুলাকে বাঁচান। কত মেয়ে গ্রাম ঘরে আপনার মুখ চেয়ে আছে। আছি আমরা, মেয়ের বাপ মা-রা। বলতে পারিনা সমাজের ভয়ে। কিন্তু আপনি পারবেন।“

উঠে দাঁড়ালেন রাজা রামমোহন রায়। বললেন, “আমায় আপনি শক্তি দিলেন। পারতে আমাকে হবেই। এখানে না হলে ব্রিটেন যাবো। প্রিভি কাউন্সিলে দরবার করবো। কথা দিলাম আপনাকে।“ বাকিটা ইতিহাস !  

 

সেই যুগে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই লড়াই কতটা কঠিন ছিল বলে বোঝানো যাবে না। কলকাতার রাজ পরিবার থেকে ভারতের পণ্ডিত সমাজ সকলে ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কম নিন্দা, অপমানের ঝড় বয়ে যায়নি তাঁর ওপর দিয়ে। কিন্তু বটবৃক্ষের মতো অটুট ছিলেন তিনি। তাঁর এই লড়াইতে, তাঁর পাশে এসেছিলেন খ্রিস্টীয় মিশনারি উইলিয়াম কেরি । কেরি সাহেবের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে অপরিসীম। উদার মনের মানুষ ছিলেন তাঁরা দুজনেই। মানুষকে ভালোবাসতেন তাঁরা। মূলত তাঁদের দুজনের লাগাতার জন সচেতনতা প্রচার এবং নানাবিধ প্রচেষ্টায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তদানিন্তন ব্রিটিশ আঞ্চলিক সরকার আইন করে ‘সতীদাহ প্রথা’ ভারতে নিষিদ্ধ করে দেয়।

 

রামমোহন রায়, ভারতের 'প্রথম আধুনিক মানুষ', এক মহান সমাজ বিবর্তক। তাঁর জন্ম হয় ২২মে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে এবং তাঁর প্রয়াণ দিবস ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ। প্রণাম জানাই তাঁকে। হে মহা মানব, প্রণমি তোমায়। তোমাকে আমরা কখনো ভুলবো না। তুমি সদা থাকবে আমাদের হৃদয় মাঝে।

 

আজ এখানেই শেষ করি কলকাতা থেকে লেখা এই চিঠি। সুন্দর হোক আপনার জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে, সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা।

 

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই ‘কলকাতার চিঠি’ পড়ে। আর পড়ে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি  Like,  Comment  করবেন এবং আপনার  facebook  page  এ  Share  করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

 

Please Like, Comment and Share this Program

#Rvapastoralcare #RVASocialMedia2018  #4thRvaOnlineTraining  #RVA  #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService  #Chitrabani #চিএবাণী #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #Kolkatar_Chithi #Raja_Rammohan_Roy #রাজা_রামমোহন_রায় #সতীদাহ_প্রথা #Sati #CustomsAndRituals

Add new comment

9 + 2 =