কলকাতার চিঠি

প্রীতিভাজনেষু,

স্বাগত জানাই ‘কলকাতার চিঠিতে’। আশা করি ভালো আছেন।

‘নীলগঞ্জ গণহত্যা’ – আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে ঘটা এক হাড় হিম করা অজানা অধ্যায় ।

নীলগঞ্জের নামটি খুব একটা পরিচিত নয় অনেকের কাছে। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সদর শহর বারাসত ও বারাকপুরের মধ্যে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম হল এই নীলগঞ্জ। সুন্দর এই গ্রামটির গভীরে লুকিয়ে আছে একটি অজানা নির্মম ইতিহাস।

১৯৪৫ সালের পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরের ‘নীলগঞ্জ গণহত্যার’ কথা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না। দু’হাজার তিনশরও বেশি আজাদ হিন্দ বাহিনীর (আইএনএ) জওয়ানকে ব্রিটিশরা ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল। একেই বলে ‘নীলগঞ্জ গণহত্যা কাণ্ড’। এখনও দুই-চার জন পুরনো মানুষ এই অঞ্চলে আছেন যারা নিজেদের চোখে দেখেছেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের মৃতদেহ ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল সেই সব ট্রাক থেকে। এই অঞ্চলের খুব কাছাকাছি আমার বাসস্থান হওয়ার সুবাদে এই রক্ত হিম হওয়া ঘটনা আমি জেনে নিথর হয়ে উঠি। অনুভব করলাম যেন মনে এক প্রকাণ্ড বড় পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার বিবেক-হৃদয় কেঁপে ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে এই নীলগঞ্জ গণহত্যা ঘটনার তথ্যগত প্রমাণ এবং এই প্রসঙ্গে কোনও নথিও দুর্ভাগ্যবশত কারোর কাছেই কিছু নেই ।

বর্তমানে ওই ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারত সরকারের ‘পাট শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান’। যার পোশাকি নাম ‘সেট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর জুট অ্যান্ড অ্যালাইড ফাইবার্স’। ভারত সরকারের কৃষি মন্ত্রকের আওতাধীন এটি। পাট শিল্প প্রতিষ্ঠানের লোকেরা এই হিমঘরে চলে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে গবেষণা পছন্দ করেন না। এঁরা এ ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নন। আর তাই কোনও ছবি সেইভাবে তোলা সম্ভবপর হয়নি।

এর পর পরই আরও ইন্টারনেটে খোঁজ করতে করতে এই ঘটনার সত্যা সত্য উন্মোচন হয় আমার কাছে। চোখে এসে যায় একটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত নথি। সেই নথিতে বলা আছে যে সময়টা ছিল ১৯৪৫ সালের ১২ অক্টোবরের। একটি চিঠি নিয়ে রয়েছে সেই নথি। চিঠি প্রেরক মেজর জেনারেল, এইচ কিউ ৩০৩ এল অফ জি এরিয়া। চিঠি পাঠানো হয়েছে — জিএস বান্ড, ডিএমআই (ডিরেক্টরেট অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স), জিএইচকিউ; দিল্লি। এই চিঠিতে রয়েছে সেই কাণ্ডের কথা। অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতের সেই ভয়ানক কাণ্ডের কথা। নীলগঞ্জ ক্যাম্পের পাহারার দায়িত্বে থাকা ২৬/৩ মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ই আর আর মেনন যুদ্ধাপরাধীদের (প্রিজনার অফ ওয়্যার) কারাগারে আসেন। আনুমানিক ১০টায় তিনি রোল কলের নির্দেশ দেন। যুদ্ধাপরাধীরা এতে অস্বীকার করেন। এরপর তিনি চলে যান। কোয়ার্টার গার্ডে অ্যালার্ম বাজিয়ে দেন ক্যাপ্টেন মেনন। ফের তিনি টমি-গান নিয়ে সেখানে আসেন। পুরো কোম্পানি তাঁর পেছন পেছন আসে। যুদ্ধাপরাধীরা তার দিকে পাথর-ইট-বাঁশ ছোঁড়েন। এতে তাঁর কোম্পানির লোকেরা চিৎকার করতে থাকেন, ‘আমাদের কোম্পানির কমান্ডার খতম।’ এরপর ব্রিটিশ ভাষ্য অনুসারে ওসি মেনন বলেন, তাঁর কোম্পানির লোকেরা গুলি চালিয়েছে। অথচ কোম্পানির লোকেরা বলেছে, ওসি মেনন গুলি চালিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এরা সবাই এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল গোটা রাত, সেখানকার যুদ্ধাপরাধীদের সবাইকে খুন করার জন্য। উল্লেখ্য যে সেই সময় ওই এলাকায় মানুষের বসবাস অনেক কম ছিল তবুও আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা গোটা রাত গুলির শব্দ শুনেছেন। পরের দিন এলাকার বাসিন্দারা দেখেছেন, ট্রাক বোঝাই করে মৃতদেহ নিয়ে যেতে। রাস্তায় ট্রাক থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তেও তারা দেখেছেন। ওই মৃতদেহগুলি পাশেই নোয়াই খালের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে বা ফেলে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের পাম গাছের পাশ থেকে কিছু মৃতদেহ খুঁড়ে তোলা হয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই গণহত্যার মাত্র তিন দিন আগে এক অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘জওয়ানের নির্দেশ মেনে থামতে অস্বীকৃত হলে বা কোনও সম্পত্তি ধ্বংস করলে বা ধ্বংস করার অভিপ্রায় রাখলে ক্যাপ্টেন বা এর ঊধর্বতন পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক বলপ্রয়োগ করতে পারেন যা মৃত্যুর কারণ অবধি হতে পারে (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট ১৯৪২, অর্ডিন্যান্স এসএলআই অফ ১৯৪২)’।

ব্রিটিশরা নিশ্চিতভাবে সহস্রাধিক যুদ্ধাপরাধীকে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে (টেকনিক্যালি যাকে বলা হত ইসিডিসি- ইস্টার্ন কম্যান্ড ডিটেনশন সেন্টার্স) রাখতে রাজি ছিল না। লালকেল্লায় বিচার পর্বের আগে এঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা বিপজ্জনক ছিল। সারা দেশে বিদ্রোহের ডঙ্কা যাতে আরও তেজী না হয়ে ওঠে সে জন্য ব্রিটিশরা এই যুদ্ধাপরাধীদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখতে চায়নি। গণহত্যা(নথিতে প্রমাণিত) শেষে ক্যাম্প খালি করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের তাড়াহুড়ো, ওই এলাকার নির্জনতা, ব্রিটিশ প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম, সব কিছু মিলে এটা স্পষ্ট - ব্রিটিশ প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পনামাফিক আজাদ হিন্দ বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের গণহত্যা চালিয়েছিল এবং সম্পূর্ণ বিষয়টি দাবিয়ে দিয়েছিল। উল্লেখ্য এই পুরো ফাইলটি ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভে আছে।

নেতাজি মিশন অবশ্য প্রতি বছর ২৫ শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠান করে নীলগঞ্জে ওই প্রতিষ্ঠানের বাইরে। কবে এই ‘নীলগঞ্জ গণহত্যা’ কাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশিত হবে, এই প্রশ্ন নেতাজি অনুরাগীদের।

Sources: https://bit.ly/38PS51D

https://bit.ly/3502IxT

সুন্দর হোক আপনাদের জীবন। ভালো থাকুন, সাবধানে সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা সহ,

অতনু দাস।

(প্রযোজক)

রেডিও ভেরিতাস এশিয়া – বাংলা বিভাগ

চিত্রবাণী, কলকাতা।

আশা করি আপনাদের ভালো লাগলো আজ এই কলকাতার চিঠিটি পড়ে। আর পড়ে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি Like, Comment করবেন এবং আপনার facebook page এ Share করে দেবেন যাতে আপনার বন্ধুরা পড়তে এবং জানতে পারেন এই কলকাতার চিঠিটি। আপনার সহযোগিতা আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।

Please Like, Comment and Share this Program

#rvapastoralcare #RVASocialMedia2018 #4thRvaOnlineTraining #rva #RadioVeritasAsia #RVA_BengaliService #Chitrabani #চিএবাণী #FacebookPage #অতনু_দাস #Atanu_Das #কলকাতার_চিঠি #kolkatar_chithi #nilgunj #Barrackpore #নীলগঞ্জ #বারাকপুর #Ina #kolkata #letter #কলকাতা #চিঠি

Add new comment

3 + 8 =